রড-সিমেন্টের বাজারেও অরাজকতা

অনেকেই কোনোমতে একখানা বাড়ি বানানো বা ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন দেখছিলেন। অনেকে বুকিংও দিয়েছেন। যে মূল্যে তারা বুকিং দিয়েছেন, এখন তার দু-তিন গুণ দাম বেশি চাইছে ডেভেলপার কোম্পানি। বেকায়দায় পড়েছেন ঠিকাদাররাও। কাজ চালাবেন না বন্ধ করে দেবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না।

বাজারে হু হু করে বেড়ে গেছে রড, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম। এক মাসের ব্যবধানে সিমেন্টের দাম বেড়েছে প্রতি ব্যাগে ১২০-১৩০ টাকা। আর রডের দাম খুচরা পর্যায়ে উঠে গেছে টনপ্রতি লাখ টাকার ওপরে।

বাজার মনিটরিংয়ের সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে মাইল্ড স্টিল (এমএস) রডের (৬০ গ্রেড) দাম ৩.৬ শতাংশ বেড়েছে, এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৬.০১ শতাংশ। আর এমএস ৪০ গ্রেডের রডে এক মাসে বেড়েছে ০.৬১ শতাংশ, এক বছরে বেড়েছে ১৭.০৮ শতাংশ।

টিসিবির এই দরে গতকাল বাজারে কোনো রড পাওয়া যায়নি। বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলে দাম বাড়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রতিটন রডে কোম্পানি ভেদে মিলগেটে (ফ্যাক্টরি মূল্য) ডিলারদের কাছে বাড়তি দাম রাখা হচ্ছে ৬-৮ হাজার টাকা। ডিলাররা খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি নিচ্ছেন ৩-৫ হাজার টাকা। আর খুচরা বিক্রেতারা টনে ১০-১৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করছেন সাধারণ ক্রেতার কাছে। সে হিসাবে মিলগেট থেকে হাতবদলে ক্রেতার কাছে পৌঁছা পর্যন্ত প্রতি টন রডে ১৯-২৮ হাজার টাকা দাম বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এক মাস আগে যে রড মিলগেট থেকে ডিলার ৮২-৮৬ হাজার টাকায় কিনেছেন, গতকাল তা কিনতে হয়েছে ৮৮-৯০ হাজার টাকায়। ডিলারদের কাছ থেকে তা খুচরা বিক্রেতাদের কিনতে হয়েছে ৯১-৯৫ হাজার টাকায়। খুচরা বিক্রেতারা সাধারণ ক্রেতার কাছে বিক্রি করেছেন ১ লাখ টাকা থেকে এক লাখ ৬ হাজার টাকায়।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, একেএস ব্রান্ডের যে রড এক মাস আগে মিলগেট থেকে প্রতিকেজি ৮২ টাকায় টাকায় ডিলাররা কিনতেন, সেই রড এখন ৮৮ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। ডিলাররা ২-৩ টাকা মুনাফা রেখে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। আবার খুচরা বিক্রেতারা কেজিপ্রতি ৮-১৫ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।

এদিকে এক মাসের ব্যবধানে বাজারে সিমেন্টের দাম বেড়েছে প্রতি ব্যাগে (৫০ কেজি) ১২০-১৩০ টাকা। এখন ৫৫০ টাকার নিচে কোনো সিমেন্ট কেনা যাচ্ছে না।

মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ

রাজধানীর একটি বাজারে রড কিনতে আসা মধ্যবাড্ডা পাঁচতলা গলির মো. সুমন মিয়া জানান, তার বাবা অনেক কষ্ট করে জমানো টাকায় বাড়ির কাজে হাত দিয়েছিলেন। একতলা নির্মাণের পর মারা যান তিনি। দুই মাস আগে বাড়িটি দোতলা করার কাজে হাত দেন সুমন।

কাজ চলার মধ্যেই ৫ আগস্ট বেড়ে যায় জ্বালানি তেলের দাম। এরপরই হু হু করে বাড়তে থাকে রড-সিমেন্টের দাম। দাম কমতে পারে ভেবে কাজ বন্ধ রাখেন তিনি। সোমবার সরকার তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমায়। আশা জাগে সুমন মিয়ার মনে। তেলের দাম কমার ফলে দাম কমেছে ভেবে গতকাল তিনি এসেছিলেন বাড্ডার রড-সিমেন্টের দোকানে।

দাম আরও বাড়তি দেখে হতাশ সুমন মিয়া বাড়ি ফিরে যান। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মধ্যবিত্তের মাথাগোজার ঠাঁইটুকুও আর বুঝি নির্মাণ করা হলো না। বাড়ি করার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেল।’

রামপুরার ঝিলকাননে একটি ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিলেন বেসরকারি চাকুরে আব্দুল মতিন। কিস্তিতে শোধ করছিলেন ফ্ল্যাটের মূল্য।

মতিন জানান, কয়েক মাস কিস্তি দেয়ার পর চলতি মাসে ডেভেলপার কোম্পানি তাকে জানায় যে, রড সিমেন্টের দাম না কমা পর্যন্ত ফ্ল্যাট নির্মাণ বন্ধ রাখবেন তারা। ফলে নির্ধারিত সময়ে মতিন মিয়াকে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হচ্ছে না। আর রড-সিমেন্টের দাম না কমলে ফ্ল্যাটের মূল্য বেড়ে যাবে এবং আড়ের মূল্যে মতিন মিয়া ফ্ল্যাট পাবেকন না। বাড়তি টাকা গুনতে হবে ফ্ল্যাটটি পেতে।

আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশের বাজারে কয়েক গুণ দাম

রড ও সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যবৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ার দোহাই দিচ্ছে। তবে গত এক মাসে বিশ্ববাজারে রডের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ০.৭৮ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে ৩ শতাংশের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক ও দেশের বাজারে দাম বৃদ্ধির ব্যবধান ২.২২ শতাংশ।

একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের দাম বেড়েছে ২.২৯ শতাংশ। আর দেশের বাজারে ১৩ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক ও দেশের বাজারে দাম বৃদ্ধির ব্যবধান ১০.৭১ শতাংশ। বর্তমানে বাজারে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট কোম্পানি ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫৪০-৫৭০ টাকা। যা আগস্টের শুরুতেও ৪৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।

এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ৯টি পণ্যের দামের পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রীর দামও নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এরপর কেউ অতিরিক্ত দাম নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, যারা অকারণে দাম বাড়াচ্ছেন, তারা ঠিক করছেন না।

এ বিষয়ে ঢাকাটাইমসের কথা হয় বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক শংকর কুমার রায়ের সাথে। হঠাৎ কেন সিমেন্টের দাম বেড়েছে, জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কোম্পানি ও প্রকারভেদে রডের পাইকারি বাজারদর: ৩১ আগস্ট

প্রতিটন রড একেএস ৮৮০০০ টাকা, কেএসআরএম ৮৮০০০, রহিম স্টিল ৮৭০০০, কিং স্টিল ৮৩০০০, প্রাইম স্টিল ৮৪০০০, পিএইচপি ৮৭৫০০, আরআরএম ৮২০০০, এইচআরআরএম ৮৪০০০, এএস ৮৩৫০০, রানি ৮৪৫০০, বায়েজিদ ৮৫০০০, বিএসআরএম ৮৯৫০০, পিএসআরএম ৮৩০০০, কেএসএম ৮৩৫০০, রহিম ৮৭০০০, ভিএসআই ৮৪৫০০, জিপিএইচ ইস্পাত ৮৭০০০, আনোয়ার ইস্পাত ৮৬৫০০, আরএসআরএম ৮৪০০০ ও জেডএসআরএম ৮৪০০০ টাকায় মিলগেট থেকে ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হয়। এক মাস আগের মূল্যের চেয়ে ৬-৮ হাজার টাকা বেশি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুল আলম খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিশ্ববাজারে রডের কাঁচামাল স্ক্যাপারের মূল্য ৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে স্ক্যাপ পাওয়াই যাচ্ছিল না। এর ওপর গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।

বন্দর ও জাহাজ ভাড়ার বৃদ্ধির কথাও বলেন শামসুল আলম খান। চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস ও লোডিং চার্জ অনেক বাড়তি। আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে জাহাজ ভাড়া ও অভ্যন্তরীণ পরিবহনে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়। এসব কারণে রডের দাম বেড়েছে।

এই রকম আরো কিছু খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button