✍️ হাফিজুর রহমান
আজ টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার বেলুয়া গ্রামের বিশিষ্ট কৃষকনেতা হাতেম আলী খান-এর মৃত্যুবার্ষিকী। কৃষকদের অধিকার আদায় ও মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আজীবন নিবেদিত এই মহান নেতাকে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
এ দেশের কৃষক আন্দোলন ও গণমানুষের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রগামী নেতা হাতেম আলী খান জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৪ সালের ২৪ নভেম্বর, বেলুয়া গ্রামে। পিতা নায়েব আলী খান ছিলেন বিত্তবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, আর মাতা সালমা খানম ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী নারী।
হাতেম আলী খানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বেলুয়া গ্রামের মক্তবে। পরে তিনি হেমনগর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে এম.এ পাস করেন। কিন্তু পৈত্রিক ধনসম্পদ ও বিলাসবহুল জীবনের মোহ ত্যাগ করে তিনি নিজেকে নিবেদন করেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে।
ছাত্রজীবনে অসহযোগ আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি রাজনীতির মাঠে নামেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি ব্যায়াম, লাঠিখেলা ও অস্ত্রচালনায় পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং নতুন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতেন নিজ হাতে।
রুশ বিপ্লব ও এম.এন. রায়ের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবে তিনি মার্কসবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হন। পরবর্তীতে কমরেড মুজাফফর আহমদ ও এস.এ. ডাংগে-র ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে ১৯২৮ সাল থেকে সার্বক্ষণিক রাজনীতি শুরু করেন।
স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে তিনি প্রকাশ করেন শ্রমজীবী মানুষের কণ্ঠস্বর — ‘চাষী মজুর’ ও ‘দিন মজুর’ নামে দুটি পত্রিকা।
গ্রামে ফিরে এসে হেমনগরের জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। তেভাগা আন্দোলন ও পরবর্তী কৃষক আন্দোলনে তার নেতৃত্ব ছিল দৃষ্টান্তমূলক।
শিক্ষার প্রসার ঘটাতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বেলুয়া জনতা উচ্চ বিদ্যালয়, বলরামপুর, নলিন ও ধুবলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নিজ হাতে ছাত্র সংগ্রহ করতেন এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠদান করতেন।
১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। তিনি ছিলেন কাগমারী সম্মেলনের প্রতিনিধি, কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি—উভয় পদেই নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তরুণদের সংগঠিত করেন, গড়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনসমর্থন।
স্বাধীনতার পর কৃষক সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৩ বছর কারাবরণ করেছেন, থেকেছেন আত্মগোপনে, কিন্তু নীতিতে ছিলেন অবিচল।
১৯৭৭ সালের ২৪ অক্টোবর, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান নেতা।
🔥 হাতেম আলী খান ছিলেন সত্যিকারের জননেতা—
নিজ শ্রেণি ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন ত্যাগ করে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সংগ্রামী জীবন।
তিনি বিশ্বাস করতেন—
“মুক্তির পথ সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়েই সম্ভব।”
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা স্মরণ করি এক নির্ভীক সংগ্রামীকে,
যিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য।
#হাতেম_আলী_খান #কৃষকনেতা #গোপালপুর #টাঙ্গাইল #বাংলাদেশের_ইতিহাস #কৃষকআন্দোলন
